বৃষ্টিপাত কাকে বলে? বৃষ্টিপাত কত প্রকার? বৃষ্টিপাত কিভাবে সৃষ্টি হয়?

বৃষ্টিপাত কি বা কাকে বলে? (What is Rainfall in Bengali/Bangla?)

স্বাভাবিকভাবে ভাসমান মেঘ ঘনীভূত হয়ে পানির ফোঁটা ফোঁটা আকারে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে ভূপৃষ্ঠে পতিত হলে তাকে বৃষ্টিপাত বলে। এই বৃষ্টিপাত কখনো প্রবল এবং কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি আকারে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়।

 

বৃষ্টিপাতের শ্রেণিবিভাগ (Classification of rainfall)

বৃষ্টিপাত মূলত চার প্রকার। যথা :

i) পরিচলন বৃষ্টিপাত।

ii) শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত।

iii) ঘূর্ণি বৃষ্টিপাত।

iv) সংঘর্ষ বৃষ্টিপাত।

নিম্নে প্রত্যেক ধরনের বৃষ্টিপাত আলোচনা করা হলো–

১। পরিচলন বৃষ্টিপাত (Convectional Rainfall)

ভূপৃষ্ঠের অধিক উষ্ণতার ফলে পরিচলন পদ্ধতিতে জলীয় বাষ্পপূর্ণ উষ্ণ বায়ু ঊর্ধ্বে উঠে ঘনীভূত হয়ে যে বৃষ্টিপাত ঘটায়, তাকে পরিচলন বৃষ্টিপাত বলে।

 

পরিচলন বৃষ্টিপাত কিভাবে হয়?

ভূপৃষ্ঠের যে সমস্ত অঞ্চলে জলভাগের বিস্তার বেশি এবং সূর্যরস্মি প্রায় লম্বভাবে পড়ে সেখানে জলভাগ থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্প বায়ুতে মেশে। এই জলীয় বাষ্পপূর্ণ উষ্ণ ও হালকা বায়ু উপরে উঠে যায়। উপরে শীতল বায়ুর সংস্পর্শে এসে এই বায়ুস্থিত জলীয় বাষ্প শীতল ও ঘনীভূত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জল কণায় পরিণত হয় এবং মেঘের সৃষ্টি করে। এই জলকণা পরস্পর যুক্ত হয়ে ক্রমশ বড় হয় এবং মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে পরিচলন বৃষ্টি রূপে ভূপৃষ্ঠে ঝরে পড়ে।

 

পরিচলন বৃষ্টিপাতের বৈশিষ্ট্য: 

১. পরিচলন বৃষ্টিপাত সাধারণত দুপুরের পর বা বিকেলের দিকে হয় তাই একে 4 o’clock rain বলে।

২. মূলত বজ্রবিদ্যুৎ-সহ মুষলধারে পরিচলন বৃষ্টিপাত হয়।

৩. এই বৃষ্টিপাত খুব কম সময় ধরে অল্প জায়গার মধ্যে পড়ে।

৪. বৃষ্টিপাতের পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়।

৫. সবচেয়ে কম পরিমাণ মেঘাচ্ছন্নতা থেকে সর্বাধিক পরিমাণ বৃষ্টিপাত এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

 

পরিচলন বৃষ্টিপাতের উদাহরণ

১.নিরক্ষীয় অঞ্চলে সারাবছর পরিচলন বৃষ্টিপাত হয়।

২. ক্রান্তীয় অঞ্চলে মৌসুমী বায়ু প্রভাবিত দেশগুলি মৌসুমী বায়ু আসার আগে পরিচালন বৃষ্টিপাত হয়।

৩. নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে গ্রীষ্মকালের শুরুতে এই বৃষ্টি হয়ে থাকে।

 

২। শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত ( Orographic Rainfall)

“শৈল” শব্দের অর্থ পর্বত এবং “উৎক্ষেপ” এর অর্থ ওপরে ওঠা। সাধারণ জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু পর্বতে বাধা পেয়ে ওপরে ওঠে ঘনীভূত হয়ে যে বৃষ্টিপাত ঘটায়, তাকে শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত বলে।

 

শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত কিভাবে হয়?

সমুদ্র থেকে আসা জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ুর প্রবাহ পথে আড়াআড়িভাবে অবস্থিত কোন পর্বতে বাধা পেলে পর্বতের গা উপরে উঠে যায়। ঊর্ধ্বগামী এই বায়ু প্রসারিত ও শীতল হতে থাকে এবং বায়ুস্থিত জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে জল কণায় পরিণত হয়। এই জলকণা গুলি পরস্পর যুক্ত হয়ে ক্রমশ বড় হতে থাকে এবং পর্বতের যে ঢাল বেয়ে বায়ু উপরে উঠে এসেছে, সেই প্রতিবাত ঢালে( Windward Side) প্রচুর শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত ঘটায়।

 

বৃষ্টি ছায়া অঞ্চল কাকে বলে?

পর্বত অতিক্রম করে এই বায়ু যখন বিপরীত অর্থাৎ অনুবাত ঢালে ( Leeward Side) এসে পৌঁছায় তখন তাতে আর জলীয়বাষ্প থাকে না। তাছাড়া নিচের দিকে নামতে থাকায় বায়ু ক্রমশ উষ্ণ হতে থাকে ফলে ঘনীভূত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাই এই ঢালে বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। একে বৃষ্টিচ্ছায় ( Rain Shadow region) অঞ্চল বলে।

 

শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত-এর উদাহরণ

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া পাহাড়ের প্রতিবাত ঢালে অবস্থিত চেরাপুঞ্জির মৌসিনরাম-এ দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বাধা পেয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত ঘটায়। কিন্তু শিলং বিপরীত পাশে থাকায় সেখানে বৃষ্টিপাত কম হয়।

 

৩। ঘূর্ণি বৃষ্টিপাত (Cyclonic Rainfall)

কোনো অঞ্চলে বায়ুমণ্ডলে নিম্নচাপ কেন্দ্রের সৃষ্টি হলে জলভাগের উপর থেকে জলীয়বাষ্পপূর্ণ উষ্ণ এবং স্থলভাগের উপর থেকে শুষ্ক শীতল বায়ু ঐ একই নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে অনুভূমিকভাবে ছুটে আসে। শীতল বায়ু ভারী বলে উষ্ণ বায়ু শীতল বায়ুর উপর ধীরে ধীরে উঠতে থাকে। জলভাগের উপর থেকে আসা উষ্ণ বায়ুতে প্রচুর জলীয়বাষ্প থাকে। ঐ বায়ু শীতল বায়ুর উপরে উঠলে তার ভিতরে জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়। এরূপ বৃষ্টিপাতকে ঘূর্ণি বৃষ্টি বলে। এই বৃষ্টিপাত সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। মধ্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শীতকালে এরূপ বৃষ্টিপাত হতে দেখা যায়।

 

ঘূর্ণ বৃষ্টিপাত কিভাবে হয়?

ঘূর্ণ বৃষ্টিপাত মূলত দু’ভাবে সৃষ্টি হয়। যথা-

১. ক্রান্তীয় ঘুর্ণবৃষ্টি

২. নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবৃষ্টি

ক্রান্তীয় ঘুর্ণবৃষ্টি

ক্রান্তীয় অঞ্চলে স্বল্পপরিসর স্থানে উষ্ণতা বেড়ে গেলে গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের সৃষ্টি হয়। তখন চারিদিকে উচ্চচাপ অঞ্চল এর শীতল ও ভারী বাতাস ওই নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে প্রবল বেগে ছুটে আসে এবং উষ্ণ হয়ে কুণ্ডলআকারে ঘুরতে ঘুরতে ওপরে উঠে। এই ঊর্ধ্বগামী উষ্ণ আদ্র বায়ু শীতল ও ঘনীভূত হয়ে বজ্রবিদ্যুৎ সহ মুষলধারে বৃষ্টি ঘটায়। এর নাম ক্রান্তীয় ঘূর্ণ বৃষ্টি।

 

নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবৃষ্টি

নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলের কোন স্থানে নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে মেরু অঞ্চল থেকে শীতল শুষ্ক বায়ু এবং ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে উষ্ণ আর্দ্র বায়ু ওই নিম্নচাপ এর দিকে ছুটে এসে দুই বায়ু পরস্পরের মুখোমুখি হলে তাদের মধ্যে আলোড়নের সৃষ্টি হয়। তখন উষ্ণ বায়ু হালকা হওয়ায় ভারী শীতল বায়ুর ওপর ধীরে ধীরে উঠে যায় এবং উষ্ণ বায়ুস্থিত জলীয় বাষ্প শীতল ও ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায় । এই বৃষ্টি নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণ বৃষ্টি নামে পরিচিত।

 

৪। সংঘর্ষ বৃষ্টিপাত

মেরুদেশীয় শীতল ও শুষ্ক বায়ু এবং ক্রান্তীয় উষ্ণ ও আদ্র বায়ু একে অপরের বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়ে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে পরস্পর মিলিত হয়। শীতল বায়ুর সংস্পর্শে উষ্ণ বায়ু শীতল ও ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়। একে সংঘর্ষ বৃষ্টিপাত বলে। যুক্তরাষ্ট্রে এ জাতীয় বৃষ্টিপাত হয়।

 

সংঘর্ষ বৃষ্টিপাতের বৈশিষ্ট্য

১. এ ধরনের বৃষ্টিপাত টানা কয়েকদিন ঝির ঝির করে হয়।

২. বৃষ্টির তীব্রতা খুব বেশি হয় না।

৩. শীতকালে এ ধরনের বৃষ্টিপাত হয়।

৪. ৩৫°-৬৫° অক্ষাংশের মধ্যে বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়।