পরিপাক হল এক ধরনের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, যার সাহায্যে জটিল, অদ্রবণীয় খাদ্যবস্তু নির্দিষ্ট এনজাইমের সহায়তায় দেহের গ্রহণ উপযোগী সরল খাদ্যে পরিণত হয়। পরিপাকের ফলে শর্করা গ্লুকোজে, আমিষ এমাইনো এসিডে এবং ফ্যাট বা চর্বি ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারলে পরিণত হয়।
পরিপাকে স্নায়ুতন্ত্র ও হরমোনের ভূমিকা
খাদ্য পরিপাক ও শ্বসন যে জটিল প্রক্রিয়া তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব প্রক্রিয়া শেষে উৎপন্ন হয় শক্তি। শক্তির সুষ্ঠু ব্যবহারই হচ্ছে সুস্থ জীবন অব্যাহত রাখার একমাত্র কৌশল। শক্তির সংরক্ষণ ও ব্যবহার প্রক্রিয়া যে কত সূক্ষ্মভাবে দেহে পরিচালিত হচ্ছে সে বিষয়টি পরিষ্কার জানতে হলে পরিপাকে স্নায়ুতন্ত্র ও হরমোনের ভূমিকা সম্বন্ধে ধারণা থাকা প্রয়োজন।
পরিপাকের জন্য বিভিন্ন এনজাইম ও অন্যান্য পদার্থের (যেমন-HCl) ক্ষরণ হয় শক্তির বিনিময়ে। শক্তির উৎপাদন ও ব্যবহার কখনও বৃথা যায় না। এ কারণে খাদ্যের অনুপস্থিতিতে শক্তি ও পদার্থ উৎপন্ন হয় না। বরং খাদ্য পরিপাকের উদ্দেশেই বিপুল পরিমাণ গ্যাস্ট্রিক জুস উৎপন্ন ও ক্ষরিত হয়। পরিপাকের প্রত্যেক ধাপের কর্মকান্ডে স্নায়ুতন্ত্র ও হরমোনতন্ত্র (অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিতন্ত্র/এন্ডোক্রিনতন্ত্র ) নিমোক্তভাবে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে।
১. লালাক্ষরণঃ দুধরনের প্রতিবর্ত ক্রিয়া মুখগহ্বরে লালাক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে। প্রথমটি হচ্ছে অনপেক্ষ প্রতিবর্ত, দ্বিতীয়টি সাপেক্ষ প্রতিবর্ত ক্রিয়া।
খাদ্য মুখগহ্বরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে অনপেক্ষ প্রতিবর্ত ক্রিয়া (unconditional reflex) শুরু হয়ে যায়। জিভের স্বাদ কুঁড়ির রিসেপ্টর খাদ্যের স্বাদে উদ্দীপ্ত হয়। এসব রিসেপ্টর থেকে সেন্সরি নিউরোন স্নায়ুউদ্দীপনা (nerve impluse) মস্তিষ্কে বহন করে। মস্তিষ্ক থেকে মোটর নিউরোনের সাহায্যে স্নায়ু উদ্দীপনা লালাগ্রন্থিতে এলে সেখান থেকে লালা ক্ষরিত হয়। যে প্রতিবর্ত ক্রিয়া মস্তিষ্ক হয়ে অতিক্রম করে তাকে করোটিক প্রতিবর্ত (cranial reflex) বলে।
দ্বিতীয় প্রতিবর্ত ক্রিয়া হচ্ছে সাপেক্ষ প্রতিবর্ত (conditional reflex)। খাবার দেখে, গন্ধ শুকে, চিন্তাভাবনা শেষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এ প্রতিবর্তের অন্তর্ভুক্ত। কেউ যদি একান্তে বসে তেতুল যা চালতার আচার মুখে দেওয়ার কথা চিন্তা করে তাহলে হয়তো লালা ক্ষরণ শুরু হয়ে যাবে। এসব আচার খাওয়ার অভিজ্ঞতা যার আছে তার ক্ষেত্রে এমনটি ঘটবে। অভিজ্ঞতার আলোকে শিক্ষা গ্রহণকে সাপেক্ষ প্রতিবর্ত বলে।
২. গ্যাস্ট্রিক জুস (রস) ক্ষরণঃ গ্যাস্ট্রিক জুসের ক্ষরণ হয় ৩টি ধাপে, প্রথমটি স্নায়ুবিক, দ্বিতীয়টি গ্যাস্ট্রিক এবং তৃতীয়টি আন্ত্রিক ধাপ।
মুখগহ্বরে খাদ্যের উপস্থিতি ও গলাধকরণের সঙ্গে সঙ্গে স্নায়ুবিক প্রতিবর্ত (স্নায়ুউদ্দীপনা) শুরু হয়ে যায়। এ উদ্দীপনা মস্তিষ্ক থেকে ভ্যাগাস স্নায়ুর মাধ্যমে পাকস্থলিতে পৌছায়। খাদ্য দেখা, গন্ধ ও স্বাদ নেওয়া, এমনকি চিন্তা করলেও একই অবস্থা হবে। পাকস্থলির গ্যাস্ট্রিক গ্রন্থিগুলো গ্যাস্ট্রিক জুস ক্ষরণে উদ্দীপ্ত হয়। এটি হচ্ছে প্রস্তুতি পর্ব। পাকস্থলিতে খাদ্য পৌছার আগেই এটি ঘটে এবং এভাবে পাকস্থলি খাদ্য গ্রহণে প্রস্তুত হয়। পাকস্থলির ক্ষরণে স্নায়ুবিক পর্যায় প্রায় এক ঘন্টা স্থায়ী হয়।
গ্যাস্ট্রিক পর্ব অনুষ্ঠিত হয় পাকস্থলিতে। এখানে স্নায়ুবিক ও হরমোনাল উভয় তন্ত্রেরই ভূমিক থাকে। খাদ্য ধারণে পাকস্থলি প্রসারিত হলে প্রসারণ গ্রাহক (stretch receptor) উদ্দীপ্ত হয় এবং পাকস্থলির সাবমিউকোসায় অবস্থিত মেইসনার এর জালিকায় (Meissner’s plexus) স্নায়ুউদ্দীপনা প্রেরণ করে। সেখান থেকে স্নায়ু-উদ্দীপনা গ্যাস্ট্রিক গ্রন্থিতে পৌছে জুস ক্ষরণে উদ্দীপ্ত করে। পাকস্থলির প্রসারতা এবং খাদ্যের উপস্থিতি মিউকোসায় অবস্থিত বিশেষ এন্ডোক্রিন কোষকে গ্যাস্ট্রিন হরমোন ক্ষরণে উদ্দীপ্ত করে। গ্যাস্ট্রিন রক্ত-সংবহনের মাধ্যমে গ্যাস্ট্রিক গ্রন্থিতে এসে HCI-সমৃদ্ধ গ্যাস্ট্রিক জুস ক্ষরণে প্ররোচিত করে। গ্যাস্ট্রিক জুস ক্ষরণ প্রায় ৪ ঘন্টা স্থায়ী হয়।
তৃতীয় পর্বটি ক্ষুদ্রান্ত্রে সংঘটিত আন্ত্রিক পর্ব। এসিডধর্মী কাইম যখন প্রবেশ করে এবং ডিওডেনামের প্রাচীর স্পর্শ করে তখন স্নায়ুবিক ও হরমোনাল উভয় ধরনের সাড়া প্রদানকে উৎসাহিত করে। ক্ষুদ্রান্ত্র প্রাচীরের রিসেপ্টরগুলাে খাদ্যের উপস্থিতিতে উদ্দীপ্ত হওয়ার খবর মস্তিষ্কে পৌঁছালে প্রতিবর্ত ক্রিয়ার অংশ হিসেবে মস্তিষ্ক গ্যাস্ট্রিক জুসের ক্ষরণ কমিয়ে দেয় এবং পাকস্থলি থেকে কাইমের নির্গমন গতি মন্থর করে দেয়। এর ফলে একসঙ্গে বেশি খাদ্য অন্ত্রে প্রবেশ করতে পারে না। শুধু তাই নয়, ডিওডেনামের মিউকোসা দুধরনের হরমোন ক্ষরণ করে, কোলেসিস্টেকাইনিন (Cholecystokinin, CCK) এবং সিক্রেটিন (Secretin)। CCK আবার প্যাংক্রিওজাইমিন (Pancreozymin) নামেও পরিচিত। উভয় হরমোনই রক্তে সংবহিত হয়ে পাকস্থলি, অগ্ন্যাশয় ও যকৃতে পৌঁছায়। সিক্রেটিন পাকস্থলিতে গ্যাস্ট্রিক জুস ক্ষরণে বাধা দেয়, আর CCK পাইলোরিক স্ফিংক্টারের পেশিকে সংকুচিত করে পাকস্থলি শূন্য হতে বাধা দেয়।
৩. অগ্ন্যাশয় রস ও পিত্তঃ এসিডধর্মী কাইম যখন পাকস্থলি থেকে ডিওডেনামে প্রবেশ করে তখন সিক্রেটিন ও CCK ক্ষরিত হয়। এসিডের প্রতি সাড়া দিয়ে সিক্রেটিন ক্ষরিত হয়, CCK উদ্দীপ্ত হয় আংশিক পাচিত স্নেহ ও আমিষের উপস্থিতিতে। উভয় হরমোনই অগ্ন্যাশয় রস ও পিত্ত উৎপাদনে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে থাকে। কার্যগতভাবে সিক্রেটিন একটি এসিড বিরোধী হরমোন। এটি অগ্ন্যাশয় ও যকৃতে হাইড্রোজেন কার্বনেট আয়ন উৎপন্নকে উদ্দীপ্ত করে। ফলে অগ্ন্যাশয় রস ও পিত্ত আরও ক্ষারধর্মী তরলে পরিণত হয়। এভাবে, পাকস্থলি থেকে আসা এসিডধর্মী অবস্থা প্রশমিত হয়। CCK একদিকে পরিপাক এনজাইম ক্ষরণে অগ্ন্যাশয়কে উদ্দীপ্ত করে, অন্যদিকে, পিত্তথলিকে সংকুচিত করে ডিওডেনামে পিত্ত ক্ষরণে উদ্দীপনা যোগায়। পিত্ত যকৃতে উৎপন্ন হয়, কিন্তু সঞ্চিত ও ঘনীভূত হয় পিত্তথলিতে। পিত্তের pH 7.6-8.6।
অগ্ন্যাশয় রস ও পিত্তের ক্ষরণেও স্নায়ুনিক প্রতিবর্তের ভুমিকা আছে। পাকস্থলীতে পরিপাকের স্নায়ুবিক ও গ্যাস্ট্রিক ধাপে ভ্যাগাস স্নায়ু যকৃতকে পিত্ত ও অগ্ন্যাশয়কে এনজাইম ক্ষরণে উদ্দীপ্ত করে।
এ সম্পর্কিত আরও প্রশ্ন ও উত্তরঃ–
১। যে তন্ত্রের সাহায্যে খাদ্যদ্রব্য ভেঙে দেহের গ্রহণ উপযোগী উপাদানে পরিণত হয় ও শোষিত হয় তাকে কী বলে?
উত্তর : পৌষ্টিকতন্ত্র।
২। খাদ্যে ভেজাল হিসেবে মেশানো হয় কোনটি?
উত্তর : সরবেট।
৩। কয়ভাবে খাদ্য দেহে শোষিত হয়?
উত্তর : ২।
৪। কীসের প্রভাবে খাদ্যের জটিল উপাদানগুলো ভেঙ্গে দেহে গ্রহণযোগ্য সরল উপাদানে পরিণত হয়?
উত্তর : এনজাইম।
৫। কোষ মধ্যস্থক্রিয়া কিসের উপর নির্ভরশীল?
উত্তর : এনজাইম।
৬। মানবদেহের সবচেয়ে শক্ত অংশ কোনটি?
উত্তর : দাঁত।
৭। কত বয়সের মধ্যে স্থায়ী দাঁত ওঠে?
উত্তর : ১৮।
৮। মানুষের কত ধরনের স্থায়ী দাঁত রয়েছে?
উত্তর : ৪।
৯। কোন দাঁত দিয়ে খাবার কেটে টুকরা করা হয়?
উত্তর : কর্তন।
১০। ছেদন দাঁতের কাজ কী?
উত্তর : খাবার ছেড়া।
১১। কোন দাঁত দিয়ে চর্বন, পেষণ উভয় কাজ করা হয়?
উত্তর : অগ্রপেষণ।
১২। মাড়ির সবচেয়ে পেছনের বা শেষের দাঁত দুটোকে কী বলে?
উত্তর : আক্কেল দাঁত।
১৩। একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের প্রতি চোয়ালের মাঝখানে কতটি কর্তন দাঁত থাকে?
উত্তর : ২।
১৪। পূর্ণ বয়স্ক মানুষের প্রতি চোয়ালের মাঝখানে কতটি পেষণ দাঁত থাকে?
উত্তর : ৩।
১৫। প্রতিটি দাঁতের কতটি অংশ থাকে?
উত্তর : ৩টি।