বর্তমান সময়ে ডেঙ্গু সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক রোগের একটি। এই জ্বরে আক্রান্ত রোগী একদিকে যেমন দূর্বল হয়ে যায়, অন্যদিকে এর রেশ দীর্ঘদিন শরীরে থেকে যায়। তবে ভয়ের কিছু নেই। ডেঙ্গু প্রাণঘাতি কোনো রোগ নয়। বিশ্রাম ও নিয়মমাফিক চললে এ রোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে ডেঙ্গু রোগ কীভাবে ছড়ায়, এর চিকিৎসা, ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ইত্যাদি সম্পর্কে অনেকেই জানে না।
তাই, আজকের আর্টিকেলে ডেঙ্গু জ্বর কি? ডেঙ্গু ভাইরাস কী?ডেঙ্গু রোগের / জ্বরের লক্ষণ, ডেঙ্গু হলে করণীয় কি কি? ইত্যাদি সম্পর্কে জানানোর চেষ্টা করব। চলুন তাহলে এসব বিষয় সম্পর্কে জেনে নেই।
ডেঙ্গু জ্বর কি? ডেঙ্গু ভাইরাস কীভাবে ছড়ায়?
ডেঙ্গু জ্বর একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগ। যা এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসের কারণে হয়। সাধারণত কোন এডিস মশা কোন ডেঙ্গু রোগীকে কামড়ানোর ৮-১১ দিনের মাঝে সংক্রমণে পরিণত হয়। তাছাড়া কোন সুস্থ রোগীকে কামড়ালেও তার এ রোগ হয়।
এডিস মশা একবার সংক্রামক হলে সারাজীবন রোগ সংক্রমণ করে যেতে পারে এবং ঐ সংক্রামক মশার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই রোগের সংক্রামক হয়েই জন্মাবে।
সংক্রমিত মশার কামড়ের পর এই ভাইরাস প্রথম আশেপাশের লসিকা গন্থিতে চলে যায়। সেখান থেকে আবার লসিকা তন্ত্রে গিয়ে বিস্তার লাভ করে এবং রক্তে ছড়িয়ে পড়ে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক রক্তক্ষয়ী রূপ নিতে পারে, যাকে ডেঙ্গু রক্তক্ষয়ী রোগ বলা হয়। এর ফলে রক্তপাত হয়, রক্তে অণুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং রক্ত প্লাজমার নিঃসরণ ঘটে।
ডেঙ্গু ভইরাস কী?
ডেঙ্গু ভাইরাস ফ্লাভিভাইরাস গ্রুপের সদস্য এক ধরণের RNA ভাইরাস। এ ভাইরাস ৪ ধরণের হয়ে থাকে। এগুলো হলো –
- Den – 1
- Den – 2
- Den – 3
- Den – 4
ডেঙ্গুর লক্ষণ | ডেঙ্গু রোগের/জ্বরের লক্ষণ
বর্তমানে দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ রোগটির প্রথমিক অবস্থা নির্ণয় করলে না পারলে, মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। তাই টেনশন না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
তবে ডেঙ্গু জ্বরের/ডেঙ্গু রোগের কিছু কিছু লক্ষণ আছে, সেগুলো জানা থাকলে নিজেই বুঝা যায় যে, ডেঙ্গু হয়েছে কি-না। চলুন তাহলে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ সম্পর্কে জেনে নেই।
ডেঙ্গুর ক্লাসিক্যাল জ্বরের লক্ষণসমূহ-
- হঠাৎ উচ্চ তাপমাত্রার (40°C) দ্বিস্তরের জ্বর হয়ে থাকে।
- সারা শরীরে অর্থাৎ মাংসপেশিতে প্রচন্ড ব্যথা হয়ে থাকে। এজন্য এ জ্বরকে ব্রেকবোন ফিভারও বলা হয়।
- প্রচন্ড পেট ব্যথাও হতে পারে।
- মাথা ব্যথা ও চোখের পিছনে ব্যথা হয়।
- জ্বর হওয়ার ৪ থেকে ৫ দিনের মাঝে সারা শরীরে লালচে দানা দেখা যায়, যাকে স্কিন র্যাশ বলা হয়। এটি অনেকটা এলার্জি বা ঘামাচির মতো।
- বমি বমি ভাব হতে পারে, এমনকি বমিও হতে পারে।
- অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ হয় এবং রুচি কমে যায়।
- সাধারণত ৪ থেকে ৫ দিন জ্বর থাকার পর তা এম্নিতেই চলে যায়। অনেকের ২ বা ৩ দিন পর আবারও জ্বর আসে। একে বাই ফেজিক ফিভার বলা হয়।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের লক্ষণসমূহ–
রোগীর এই অবস্থাটি সবচেয়ে জটিল অবস্থা। এই জ্বরে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গের সাথে সাথে আরও কিছু সমস্যা দেখা দেয়। এগুলো হলো–
- শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়। যেমন- চামড়ার নিচে, নাক ও মুখ দিয়ে, মাড়ি ও দাঁত হতে, কফের সঙ্গে, রক্তবমি, পায়খানার সাথে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা, চোখের মধ্যে এবং চোখের বাহিরে, নারীদের বেলায় অসময়ে ঋতুস্রাব অথবা রক্তক্ষরণ শুরু হলে অনেকদিন পর্যন্ত রক্ত পড়তে থাকা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।
- অনেক সময় আবার বুকে পানি, পেটে পানি ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। আবার অনেক সময় লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস হয়।
- কিডনি আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর এর জটিলতা দেখা দিতে পারে। ইত্যাদি।
ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের লক্ষণগুলো হলো–
ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহ রূপ হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের সাথে সার্কুলেটরি ফেইলিউর হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়ে থাকে। এর লক্ষণগুলো নিম্নে দেওয়া হলো –
- হঠাৎ করে রক্তচাপ কমে যাওয়া।
- নাড়ীর স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও খুব দ্রুত হয়।
- হাত পা ও শরীরের অন্যান্য অংশ ঠান্ডা হয়ে যায়।
- প্রস্রাব কমে যায়।
- হঠাৎ করে রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
- অনেক সময় রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। ইত্যাদি।
ডেঙ্গু হলে করণীয় কি কি? ডেঙ্গু জ্বরের প্রাথমিক চিকিৎসা।
ডেঙ্গু হলে করণীয়গুলো হলো–
- প্রাথমিক অবস্থায় বাড়িতে থেকেই ডেঙ্গুর চিকিৎসা করানো সম্ভব। এক্ষেত্রে জ্বর এবং শরীর ব্যাথা কমানোর জন্য আপনাকে প্যারাসিটামল (নাপা, এইস বড়ি) চালিয়ে যেতে হবে।
- পূর্ণ বিশ্রাম প্রয়োজন। জ্বর চলাকালীন আপনাকে বিশ্রামে থাকতে হবেই এমনকি জ্বরের পর এক সপ্তাহ পর্যন্ত বিশ্রাম নিলে আপনি জ্বরের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
- প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে।
- ফলের রস, ডাবের পানি ও স্যালাইন পান করতে হবে।
- বেদনানাশক ঔষধ সেবন করা যাবে না।
- কুসুম গরম পানি বা নরমাল তাপমাত্রার পানি দ্বারা সারা শরীর মোছতে হবে।
- ডেঙ্গু জ্বর সেরে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর যদি শরীর আরও বেশি খারাপ হতে থাকে, তবে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। রক্ত পরীক্ষা করে অণুচক্রিকার এবং হেমাটোক্রিটের পরিমাণ জেনে নিতে হবে।
- রক্তের অণুচক্রিকা কমতে থাকলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
- অণুচক্রিকা ১০ হাজারের নিচে নেমে গেলে কিংবা রক্তক্ষরণ শুরু হলে রক্ত দিতে হবে।
তবে অবস্থা যদি আরও গুরুতর পর্যায়ে চলে যায়, তাহলে রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করে যথাযথ চিকিৎসা দিতে হবে।
ডেঙ্গু হলে ডাক্তার কখন দেখাতে হবে?
ডেঙ্গু জ্বরের জন্য নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই। এ জ্বর নিজ থেকেই ভালো হয়ে যায়। তাই লক্ষণ অনুযায়ী সাধারণ চিকিৎসা করাই যথেষ্ট। তবে এমন কিছু কিছু লক্ষণ আছে যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এসব লক্ষণগুলো হলো –
- শরীরের যেকোন অংশ থেকে রক্তপাত হলে।
- রক্তের প্লাটিলেটের মাত্রা কমে গেলে।
- প্রস্রাবের মাত্রা কমে গেছে।
- জন্ডিস দেখা দিলে।
- অতিরিক্ত দুর্বলতা বা ক্লান্তি দেখা দিলে।
- প্রচুর পেট ব্যথা বা বমি হলে।
যে সব প্যাথলজি পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু জ্বর শনাক্ত করা যায়
- কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সি.বি.সি)
- এন এস ওয়ান এন্টিজেন NS1 AG পরিক্ষার
- ডেঙ্গু এন্টিবডি টেস্ট
যেকোন সরকারি হাসপাতাল / ভালো মানের ক্লিনিক / ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে খুব অল্প খরচে টেস্টগুলো করা যায়।
ডেঙ্গু হলে কী খাবেন আর কি খাবেন না?
ডেঙ্গু জ্বর হলে আপনাকে খাবারের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। বিশেষজ্ঞরা এসব রোগীদের কয়েকটি খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। একই সাথে কিছু কিছু খাবার এড়িয়ে যেতেও বলেছেন। চলুন এসব সম্পর্কে জেনে নেই –
ডেঙ্গু হলে যে খাবারগুলো বেশি করে খাবেন
- কমলা: কমলা ও কমলার রস ডেঙ্গু জ্বরের জন্য ভালো কাজে আসতে পারে। কারণ কমলাতে ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিওক্সিডেন্ট রয়েছে। এ দুটি উপাদান ডেঙ্গু জ্বর নিয়ন্ত্রণে ভালো কাজ করে।
- ডালিম: ডালিমে প্রচুর ভিটামিন আছে। সেই সাথে এতে পরিমাণ মতো মিনারেলও আছে। নিয়ম করে ডালিম খেলে প্লেটলেটের সংখ্যা বেড়ে যাবে। তাছাড়া ক্লান্তি ও অবসাদ অনুভূতিও দূর হবে।
- ডাবের পানি: ডেঙ্গুর জ্বর হলে শরীরে পানি শূন্যতা সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি হয় ডিহাইড্রেশন। এ সময় বেশি বেশি করে ডাবের পানি পান করলে উপকার পাওয়া যাবে। কারণ ডাবে ইলেক্ট্রোলাইটসের মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান রয়েছে।
- পেঁপে পাতার জুস: ডেঙ্গু জ্বর হলে রোগীর শরীরে প্লেটলেটের সংখ্যা কমে যেতে পারে। পেঁপে পাতায় রয়েছে পাপাইন এবং কিমোপেইনের মতো এনজাইম যা হজমে সহায়তা করে। একই সাথে প্লেটলেটের পরিমাণও বাড়াতে সাহায্য করে। তাই আপনাকে প্রতিদিন নিয়ম করে ৩০ এমএল পেঁপে পাতার তৈরি জুস খেতে হবে।
- মেথি: ডেঙ্গু জ্বরের জন্য মেথি উপকারী। এটি অতি সহজে ঘুমিয়ে যেতে সাহায্য করে । একই সাথে অতিরিক্তমাত্রার জ্বর কমিয়ে আনতেও সহায়তা করে থাকে। তবে মেথি গ্রহণ করার পূর্বে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে পরমার্শ করে নিতে হবে।
- ব্রুকলি: ব্রুকলি হলো ভিটামিন কে এর একটি ভালো উৎস। অন্যদিকে ভিটামিন কে রক্তের প্লেটলেট বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং খনিজ সমৃদ্ধ উপাদান। যদি কোনো ব্যক্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়; তাহলে অবশ্যই বেশি করে ব্রুকলি খাওয়াবেন।
- পালংশাক: পালংশাকে প্রচুর পরিমাণে আইরন এবং ওমেগো-থ্রি ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়। এই শাকটি বেশি করে গ্রহণ করলে অতি দ্রুত প্লেটলেট বৃদ্ধি পায়।
ডেঙ্গু জ্বরের সময় যে খাবারগুলো এড়িয়ে চলা উচিত
তৈলাক্ত ও ভাজা খাবার: ডেঙ্গু জ্বর হলে অবশ্যই তৈলাক্ত ও ভাজা খাবরগুলো এড়িয়ে চলা উচিত। এই খাবারগুলো খেলে উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি পেতে পারে।
- মসলাযুক্ত খাবার: ডেঙ্গু রোগীকে অবশ্যই মসলাযুক্ত খাবারগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। এই ধরনের খাবার বেশি করে খেলে পাকস্থলীর দেয়াল নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
- ক্যাফিনযুক্ত পানীয়: ডেঙ্গু হলে তরল খাবার বেশি করে খেতে হবে। সেই সঙ্গে ক্যাফিনযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। এই খাবারগুলো হার্ট রেট বাড়িয়ে দিতে পারে। সেই সঙ্গে ক্লান্তি নিয়ে আসতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধ করবেন কিভাবে?
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধ করতে হলে আমাদের ডেঙ্গু ফিভার ভাইরাস (DENV) কে প্রতিরোধ করতে হবে আর সেটার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো এই ভাইরাসের বাহক তথা এডিস মশাকে নির্মূল করা। নিম্নোক্ত উপায়ে আমরা ডেঙ্গুকে প্রতিরোধ করতে পারি-
- বাড়ির সামনে কোন পানি জমতে দেবেন না। বাড়ির সামনে কোথাও পানি জমে থাকলে তা পরিস্কার করে ফেলুন। কারণ জমা পানি ডেঙ্গু ভাইরাস বাহিত এডিস মশার বংশ বিস্তারের অনুকুল পরিবেশ তৈরি করে।
- এডিস মশার কামড় এড়ানোর জন্য দিনে এবং রাতে ঘুমাবার সময় আবশ্যই মশারি ব্যবহার করুন।
- বাচ্চাদের ঢিলা ঢালা ফুল হাতা জামা-প্যান্ট পরিয়ে রাখুন।
- ঘরে মশা মারার ঔষধ বা কয়েল ব্যবহার করুন।
- ঘর-বাড়ির ভিতরে ফুলের টবে এবং অন্য কোথাও পানি জমতে দিবেন না।
- আশে পাশে কোনরকম আবর্জনা জমতে দিবেন না।
- বসবাসের চারপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে যাতে করে মশার বংশবিস্তার রোধ হয়। ইত্যাদি।