ক্রোমোজোম (Chromosome) হচ্ছে নিউক্লিক এসিড (DNA, RNA) ও প্রোটিন দ্বারা গঠিত কোষের একটি জটিল অঙ্গ, যার মধ্যে জীবের সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে। ক্রোমোজোমকে বংশগতির বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক বলা হয়।
ক্রোমোজোমগুলো সাধারণত কেবল কোষ বিভাজনের মেটাফেজ দশাতেই আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে দৃশ্যমান হয়। কারণ, এই পর্যায়ে ক্রোমোজোমগুলো সবচেয়ে ঘনীভূত হয়ে কোষের বিষুবীয় অঞ্চলে সজ্জিত থাকে। এটি ঘটার আগে, প্রতিটি ক্রোমোজোমের অনুলিপি হয়ে (এস ফেজ) উভয় অনুলিপিই একটি সেন্ট্রোমিয়ার দ্বারা যুক্ত হয়। সেন্ট্রোমিয়ারটি ক্রোমোজোমের মাঝামাঝি অবস্থান করলে একটি X-আকৃতির কাঠামো তৈরি হয়। অন্যদিকে সেন্ট্রোমিয়ারটি কোনও একদিকে অবস্থান করলে দুই-বাহুবিশিষ্ট কাঠামোর সৃষ্টি হয় এতে সংযুক্ত অনুলিপিগুলোকে সিস্টার ক্রোমাটিড বলা হয়। মেটাফেজের সময় X-আকৃতির কাঠামোটিকে মেটাফেজ ক্রোমোজোম বলা হয়। এই পর্যায়ে ক্রোমোজোম অত্যন্ত ঘনীভূত হয় এবং এদের মধ্যে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা ও পর্যবেক্ষণ করা সবচেয়ে সহজ। প্রাণীকোষে ক্রোমোজোমগুলো পৃথকীকরণের সময় অ্যানাফেজ দশায় তাদের সর্বোচ্চ সংকোচনের স্তরে পৌঁছায়।
মিয়োসিস এবং পরবর্তী যৌন প্রজননের সময় ক্রোমোসোমাল পুনর্মিলন জেনেটিক বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্রোমোসোমাল অস্থিরতা এবং ট্রান্সলোকেশন নামে পরিচিত প্রক্রিয়াগুলোর মাধ্যমে এই কাঠামোগুলোকে যদি ভুলভাবে পরিচালনা করে, তবে কোষটি মাইটোটিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যেতে পারে। সাধারণত, এটি কোষটিকে কোষপতন শুরু করবে যা তার নিজের মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাবে, তবে কখনও কখনও কোষের মিউটেশন এই প্রক্রিয়াটিকে বাধা দেয় এবং এইভাবে ক্যান্সারের অগ্রগতি ঘটায়।
কেউ কেউ ক্রোমোজোম শব্দটিকে বিস্তৃত অর্থে ব্যবহার করে, কোষে ক্রোমাটিনের স্বতন্ত্র অংশগুলোকে বোঝাতে, হয় দৃশ্যমান বা হালকা মাইক্রোস্কোপির অধীনে নয়। অন্যরা ধারণাটিকে সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করে, কোষ বিভাজনের সময় ক্রোমাটিনের স্বতন্ত্র অংশগুলোকে বোঝাতে, উচ্চ ঘনীভবনের কারণে হালকা মাইক্রোস্কোপির অধীনে দৃশ্যমান।
ক্রোমোজোমের ইতিহাস (History of Chromosome)
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে একাধিক বিজ্ঞানীর নিরলস গবেষণার ফলে ক্রোমোজোম আবিষ্কৃত হয়। ১৮৭৫ সালে E. Strasburger সর্বপ্রথম ক্রোমোজোম আবিষ্কার করেন, কিন্তু তিনি এর কোন নামকরণ করেননি। ১৮৭৯ সালে W. Fleming ক্রোমোজোমের দ্বিবিভাজন লক্ষ করেন। Waldeyer ১৮৮৮ সালে সর্বপ্রথম ক্রোমোজোম শব্দটি ব্যবহার করেন।
ক্রোমোজোমের ভৌত গঠন (Physical structure of chromosome)
একটি কোষের সমস্ত ক্রোমোজোম একই দৈর্ঘ্যের হয় না। প্রজাতিভেদে এগুলোর দৈর্ঘ্য সাধারণত 0.25-50um এবং প্রস্থ 0.2 – 2um। মাইটোসিস বিভাজনের মেটাফেজ ধাপে ক্রোমোজোমগুলো স্থূল, প্যাঁচানো ও দন্ডাকার সূত্র হিসেবে দৃষ্টিগোচর হয়। তাই, মেটাফেজ ধাপ ক্রোমোজোমের আঙ্গিক গঠন পর্যবেক্ষণের উপযুক্ত সময়। একটি আদর্শ ক্রোমোজোমে নিম্নোক্ত অংশগুলো দেখা যায়।
১। ক্রোমাটিড (Chromatid) : প্রত্যেক ক্রেমোজোম দুটি প্রতিসম ও সমান্তরাল লম্বা সূতার মতো ক্রোমাটিড নিয়ে গঠিত। প্রতিটি ক্রোমাটিডে অনুদৈর্ঘ্যভাবে সাজানো দুই বা ততোধিক সূক্ষ্ণ সূত্রাকার ক্রোমোনেমাটা (chromonemata; একবচনে-ক্রোমোনেমা) নিয়ে গঠিত। প্রতিটি ক্রোমোনেমা দৈর্ঘ্য বরাবর কতগুলো নির্দিষ্ট আকার এবং আয়তনের পুতির দানার মতো (bead like) বস্তু ধারণ করে। এগুলোকে ক্রোমোমিয়ার (chromomere) বলে। DNA অণু কুন্ডলিত হয়ে এগুলো সৃষ্টি হয় বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। মিয়োসিসের প্রোফেজ-১-এর সূচনালগ্নে প্যাকাইটিন উপধাপে ক্রোমোজোমের দেহে ক্রোমোমিয়ারগুলো সুস্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়। মাইটোসিস ধাপে কোন ক্রেমোমিয়ার দেখা যায় না।
২। সেন্ট্রোমিয়ার (Centromere) : দুটি ক্রোমাটিড যে গোলাকার, বর্ণহীন ও সংকুচিত বিন্দুতে যুক্ত থাকে তার নাম সেন্ট্রোমিয়ার। সেন্ট্রোমিয়ার এক বা একাধিক ক্ষুদ্র ক্রোমোমিয়ার এবং সূক্ষ্ণ তন্তু নিয়ে গঠিত। সেন্ট্রোমিয়ার যে স্থানে অবস্থান করে সেখানে একটি খাঁজের সৃষ্টি হয়। এর নাম প্রাইমারি কুঞ্চন (primary constriction)। এর উভয় দিকের সম বা অসম আকৃতির অংশকে ক্রোমোজোমের বাহু (arm) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। স্বল্পসংখ্যক ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিটি ক্রোমোজোমে একটি মাত্র সেন্ট্রোমিয়ার থাকে।
৩। সেকেন্ডারি কুঞ্চন বা খাঁজ (Secondary constriction) : সেন্ট্রোমিয়ারের প্রাইমারি খাঁজ ছাড়াও ক্রোমোজোমের উভয় বাহুতে এক বা একাধিক সেকেন্ডারি কুঞ্চন থাকতে পারে। এ কুঞ্চনকে নিউক্লিওলাস পুনর্গঠন অঞ্চল নামেও অভিহিত করা হয়।
৪। স্যাটেলাইট (Satellite) : কোন কোন ক্রোমোজোমের এক বাহুর প্রান্তে ক্রোমাটিন সূত্র দিয়ে সংযুক্ত প্রায় গোলাকার একটি অংশ দেখা যায়। এ গোলাকার অংশকে স্যাটেলাইট বলে। এরূপ স্যালোইটযুক্ত ক্রোমোজোমকে স্যাট ক্রোমোজোম (sat chromosome) বলা হয়।
৫। টেলোমিয়ার (Telomere = গ্রিক, telos = প্রান্ত এবং meros = অংশ) : বিজ্ঞানী এইচ. জে. মুলার (H.J.Muller) ক্রোমোজোমের প্রান্তদেশে টেলোমিয়ার নামক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অঞ্চলের কল্পনা করেন। তাঁর মতে টেলোমিয়ারের অবস্থানের কারণেই ক্রোমোজোমের প্রান্তদুটি সংযুক্ত হতে পারে না।
৬। বহিঃপর্দা বা পেলিকল (Pellicle) : আগে ধারণা করা হতো যে ক্রোমোজোমের অভ্যন্তরীণ অংশগুলো একটি বহিঃপর্দা বা পেলিকল দিয়ে আবৃত। ম্যাক ক্লীন্টক, সোয়ানসন প্রমুখ কোষবিজ্ঞানী পেলিকল সম্পর্কে আস্থাবান হলেও ডার্লিংটন, রিস প্রমুখ বিজ্ঞানীরা ভিন্নমত পোষণ করেন। ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্রে পেলিকলের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি।
ক্রোমোজমের কাজ (Functions of Chromosome)
১। ক্রোমোজোম পিতামাতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সন্তান-সন্ততিতে সঞ্চারিত করে।
২। নিউক্লিয়াসের আকার-আকৃতি প্রদান করে।
৩। প্রোটিন সংশ্লেষ নিয়ন্ত্রণ করে।
৪। ক্রোমোজোমে অবস্থিত জিন প্রজাতির বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে।
৫। সেন্ট্রোমিয়ার নিউক্লিয়ার বিভাজনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
Tags :
- ক্রোমোজোম বলতে কি বুঝ?
- ক্রোমোমিয়ার মানে কি?
- ক্রোমাটিড এর কাজ কি?
- ক্রমোজোম কে আবিষ্কার করেন?
- মানুষের শরীরে ক্রোমোজোমের সংখ্যা কত?
- ক্রোমোজোমের কাজ
- ক্রোমোজোম কোথায় থাকে
- ক্রোমোজোম সৃষ্টি হয় কি থেকে
- ক্রোমোজোম চিত্র
- x y ক্রোমোজোম
- স্যাটেলাইট যুক্ত ক্রোমোজোম কে কি বলে
- ক্রোমোজোম শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন কে?
- ক্রোমোজোমের প্রধান উপাদান
- মানুষের দেহকোষে ক্রোমোজোম সংখ্যা কত
- জনন কোষে ক্রোমোজোম সংখ্যা কত
- Y ক্রোমোজোম কি
- ক্রোমোজোম কয় প্রকার ও কি কি
- স্যাটেলাইট থাকে ক্রোমোজোমের কোথায়
- ক্রোমোজোম এর গঠন ও কাজ
- ক্রোমোজোমের ভৌত গঠন